চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে ব্যয় হয়েছে মাত্র ২ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮১ কোটি।
এই ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশই গেছে সুদ ও ভর্তুকি পরিশোধের পেছনে। জানুয়ারি পর্যন্ত সুদ ও ভর্তুকি খাতে যে বরাদ্দ ছিল তার চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি ব্যয় হয়েছে। আর উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৭০ হাজার কোটি টাকা।
বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে বাকি ৪ মাসে (মার্চ-জুন) ব্যয় করতে হবে ৪ লাখ ২৯ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশ। সেই হিসাবে প্রতি মাসে ব্যয় দাঁড়াবে ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা।
এসব তথ্য তুলে ধরা হয় সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সরকারের আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে শেষ ৪ মাসে তড়িঘড়ি করে বিপুল অঙ্ক খরচ করতে গিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে-এমন আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। তাদের মতে, এতে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও ব্যয়ের গুণগতমান নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে শেষ সময়ে বিপুল অঙ্কের খরচের বিষয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় অর্থবিভাগ।
ওই চিঠিতে বলা হয়-বছরের শেষ সময়ে মন্ত্রণালয়গুলোর অস্বাভাবিক খরচের কারণে সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। কিন্তু শুরুতে ব্যয় হয় ধীরগতিতে।
অপরদিকে রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয়-এ দুয়ের মধ্যে কোনো পরিকল্পনা থাকছে না। এতে অপরিকল্পিত ঋণ গ্রহণ এবং ঋণ সংক্রান্ত ব্যয়ের দায়ভার বহন করতে হয় সরকারকে। যা আর্থিক শৃঙ্খলাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বছরের শুরুতে অর্থ ব্যয়ের জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, এটি দীর্ঘদিনের পুরোনো একটি সমস্যা। মন্ত্রণালয়গুলো প্রথম দিকে টাকা ব্যয় কম করে। আবার শেষ দিকে খরচের হিড়িক পড়ে। আর তখনই কাজের এবং অর্থ ব্যয়ের দুটোর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠে। আমি মনে করি অর্থ ব্যয়ের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এর জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। না হলে একই সমস্যা প্রতিবছরই ঘটবে। কেন তারা প্রথমদিকে অর্থ ব্যয় করতে পারে না, শেষদিকে কেন ব্যয় বাড়িয়ে দেয় সেটির জবাব নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্রমতে, আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে সরকারের আয়-ব্যয় ঘাটতি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে রাজস্ব আহরণ, মোট ব্যয়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন ও পরিচালন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে আছে।
ওই বৈঠকে অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতি করোনা ভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাতের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন, নিত্যপণ্যের আমদানি স্বাভাবিক রাখতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ভর্তুকি দেওয়া এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সফল হওয়ায় আগামীতে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।
বাজেটের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু অর্থবছরের আট মাসে ব্যয় হয় মাত্র ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। বাকি প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যয় করতে হবে জুনের মধ্যে। যদিও বর্তমান মে চলছে। সরকার এখনও মে মাস পর্যন্ত ব্যয়ের হিসাব চূড়ান্ত করেনি। তবে চার মাসে ৬০ শতাংশ ব্যয় করতে হলে দৈনিক ব্যয় করতে হবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা করে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এডিপির টাকা কম খরচের কারণে প্রথম ৭-৮ মাস বাজেটের সঙ্গে ব্যয়ের একটি বড় ব্যবধান তৈরি হয়। তবে মন্ত্রণালয় থেকে শেষ ২ মাসে অতিরিক্ত ব্যয়ের একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। সেটি হচ্ছে, কাজ সারা বছর চলে, কিন্তু ঠিকাদাররা বিল জমা দেন মে ও জুনে। যে কারণে অর্থ পরিশোধও বেশি হয় এ ২ মাসে।
এখানে প্রশ্ন উঠে, সারা বছর টাকা বরাদ্দ না নিয়ে ঠিকাদাররা কাজ করেন, এটি কিভাবে সম্ভব। তারা টাকা কোত্থেকে পান। বকেয়ার মাধ্যমে এডিপির কাজ হয় সারা বছর, এটি বিশ্বাস করা কঠিন, তেমনি ঠিকাদারদের পক্ষে কাজ করাও কঠিন। এর মানে-কাজ হোক বা না হোক, যেসব খাতের টাকা ব্যয় হয়নি বা টাকা ফেরত যাবে এসব ফান্ড তড়িঘড়ি করে ছাড় করা হয় বছরের শেষদিকে।
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন এর মাধ্যমে একটি বড় অপচয়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এটি প্রতিবছরই রীতি হয়ে গেছে।
তড়িঘড়ি করে অর্থ ব্যয় কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ তৈরি করে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনিয়ম ছাড়া এসব অর্থ ছাড় সম্ভব হবে না। বাজেট নথি বিশ্লেষণ করে আরও দেখা গেছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে সরকারের পরিচালন খাতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৪১ শতাংশ।
তবে ব্যয়ের বড় অংশই গেছে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, ঋণের সুদ ও ভর্তুকিতে। জানুয়ারি পর্যন্ত (প্রথম ৭ মাস) সুদ ও ভর্তুকির পেছনে ৮৮ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়। যা এই দুই খাতের বরাদ্দের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সুদ ও ভর্তুকি ব্যয় ৮ মাসে প্রায় লাখ কোটি টাকায় ছুঁইয়েছে। এ পর্যন্ত সুদ মেটাতে ৬০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা গেছে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ ১৫ শতাংশ বেড়ে ৫১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা হয়েছে। বিদেশি ঋণের বিপরীতে তা তিন গুণ বেড়ে হয়েছে নয় হাজার ৩৪২ কোটি টাকা।
পাশাপাশি ভর্তুকিতে ব্যয়ও বেড়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, এলএনজি ও সারের দামের ঊর্ধ্বমুখী বিরাজ করছে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয় ২৭ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, আগের অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ২৬ হাজার ২১২ কোটি টাকা। প্রকৃত ভর্তুকি খরচ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে সরকারের কৃচ্ছ সাধন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক সংকটের কারণে এডিবিতে অর্থ ব্যয় কম হয়েছে। ৮ মাসে খরচ হয়েছে মোট লক্ষ্যমাত্রার ২৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। যদিও কৃচ্ছ সাধনের সময়েও গত অর্থবছরেও এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৩২.১০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগসহ সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয়, বিভাগগুলোর মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নের হার সবচেয়ে কম।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়ার পরও অনেক মন্ত্রণালয়ের ব্যয় করার সক্ষমতা থাকছে না। এটি একটি সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে অর্থ ব্যয়ের কোনো পরিকল্পনা নেই, বছরের শুরুতে বেতন-ভাতা, ইউটিলিটি বিল ছাড়া অন্য কোনো ব্যয় তেমন করা হয় না। কিন্তু শেষ দিকে আবার অস্বাভাবিকভাবে টাকা খরচ হয়।
এজন্য আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার কর্মকর্তাদের অর্থ ব্যয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছি। তবে ব্যয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েল ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বাজেটের টাকা খরচের সক্ষমতার অভাব হচ্ছে মূল কারণ। অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা অর্থ সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করতে পারেন না।
এদিকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একই সময়ে রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। যে কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রয়োজনীয় অর্থ এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ধীরগতি দেখা যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর আদায় করেছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। এ করসহ মোট আয় হয় ২ লাখ ৫১ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। এ বছর মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণ কম হওয়ায় ঋণের ওপর ঝুঁকছে বেশি সরকার।
Leave a Reply