৫ প্রতিষ্ঠান সিলগালা, টানানো হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড * দুদিনে ৪৪৫ প্রসিকিউশন দিয়েছে ডিএমপি
রাজধানীর রেস্তোরাঁয় মঙ্গলবারও চতুর্মুখী অভিযান চলেছে। নগর সংস্থাগুলো পৃথক অভিযানে ৫ প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দিয়েছে। কোনো কোনো ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড লাগিয়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। দুদিনে পুলিশের অভিযানে ৮৭৪টি প্রতিষ্ঠানের ৪৪৫ জনকে প্রসিকিউশন দেওয়া হয়েছে। এমন অভিযানে আতঙ্কিত রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা। তারা ব্যাংকঋণ, কর্মচারীদের বেতন কীভাবে দেবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এদিকে অভিযানের খবরে অনেক রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা পালিয়ে গেছেন।
মঙ্গলবার বেইলি রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারটি রেস্টুরেন্টকে সিলগালা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। একই সঙ্গে খিলগাঁওয়ে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সেখানে একটি ভবন সিলগালা করা হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে ভবনটি চিহ্নিত করে নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর থানায় থানায় পুলিশ সদস্যরা রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা করেছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বেইলি রোডে রাজউকের অভিযানে নবাবী ভোজ, সুলতান’স ডাইন, পিজ্জা মাস্তান, রোস্টার ক্যাপকে সিলগালা করে দেওয়া হয়। বেইলি রোডের একটি দোতলা ভবনের নিচতলায় নবাবী ভোজ রেস্তোরাঁ। ভবনটির ওপরের তলায় পোশাকের একটি ব্র্যান্ডের শোরুম রয়েছে। সুলতান’স ডাইনের বিষয়ে রাজউকের কর্মকর্তারা বলেন, রেস্তোরাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তবে তারা দাবি করেছেন, তাদের সব কাগজপত্র আছে। তাই আপাতত রেস্তোরাঁটি সিলগালা করা হয়েছে। কাগজপত্র দেখাতে পারলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সরেজমিন আরও দেখা যায়, ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টার নামের একটি ভবনের অগ্নিসুরক্ষার ছাড়পত্র হালনাগাদ না থাকায় দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টার ভবনটির পরিচালক সারফুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সবকিছু ঠিক আছে। শুধু ফায়ারের ছাড়পত্র এখনো পাইনি। একই সঙ্গে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় সুইস বেকারিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
অভিযান পরিচালনাকারী রাজউকের অঞ্চল-৭-এর পরিচালক মনির হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘রাজউক নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। শুধু রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে না। যেখানেই সমস্যা বা কোনো ব্যত্যয় পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, বেজমেন্টে রেস্টুরেন্ট, অপ্রশস্ত সিঁড়ি এবং পুরো ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকায় খিলগাঁওয়ের নাইটিঙ্গেল স্কাইভিউ টাওয়ার সিলগালা করে দিয়েছেন ডিএসসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারা আরও জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ৯১৯/১ হোল্ডিংয়ের নাইটিঙ্গেল স্কাইভিউ টাওয়ারে গেলে সেখানে দ্বিতীয় তলার শর্মা কিং বাদে সাততলা ভবনের বাকি সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ দেখতে পান। এ সময় আদালত ভবনের বেজমেন্টসহ যত্রতত্র রেস্টুরেন্ট ও রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বলে দেখতে পেয়েছেন। মাত্র ৩ ফুট প্রশস্ত ১টি সিঁড়ি থাকায় এবং পুরো ভবনের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা অপর্যাপ্ত থাকায় ভবনটি অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। পরে সাড়ে ১২টার দিকে ওই এলাকার ‘কাচ্চি ভাই’ ও ‘সিরাজ চুইগোস্ত’ নামে দুটি রেস্তোরাঁয় যান ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু তালা দেওয়া ওই দোকান দুটির গেটে রেস্টুরেন্টের উন্নয়ন কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটি সাময়িক বন্ধ ব্যানার ঝুলছিল। তাই সেখানে অভিযান পরিচালনা করতে পারেননি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অভিযানে ভবনটির বেজমেন্টসহ যত্রতত্র রেস্টুরেন্ট এবং অপ্রশস্ত সিঁড়ি। এছাড়াও বিল্ডিং কোড অনুযায়ী সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিঁড়ি ছিল না এবং রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে তোলার চিত্র দেখা গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পুরো ভবনটি আমরা সিলগালা করে দিয়েছি। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ এর ১৮ ধারা অনুযায়ী এই ভবন সিলগালা করা হয়। ফায়ার সার্ভিস ‘ভবনটি অগ্নিনিরাপত্তার জন্য অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ’ ব্যানার টানিয়ে দিয়েছে।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ সংশ্লিষ্ট থানার আওতাধীন রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা করেছে। বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে দুই দিনের টানা ৮৪৭ অভিযানে ৪৪৫টি প্রসিকিউশন দেওয়া হয়েছে। অভিযান টের পেলেই ভয়ে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে পালাচ্ছেন কর্মচারীরা। এসব রেস্তোরাঁর বেশির ভাগেরই নেই অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা। অভিযানে পুলিশ কাউকে আটক করছে আবার কাউকে সতর্ক করছে।
অভিযানসংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ রেস্তোরাঁয় ঝুঁকিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয় ফায়ার এক্সটিংগুইশার নেই। রেস্তোরাঁগুলোর অধিকাংশের ভবনের সিঁড়ি সরু। বাসাবাড়ির ভবনে চলছে রেস্তোরাঁ ব্যবসা। একই ভবনে শপিংমল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে অসংখ্য স্থানে। গ্যাস সিলিন্ডারগুলো সব থেকে অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশিনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, অভিযান চলমান আছে। যেখানে অসংগতি দেখা যাচ্ছে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা খেয়াল রাখছি যাতে মানুষ কোনো রকম হয়রানির শিকার না হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র বলছে, সোমবার ডিএমপির আটটি বিভাগের ৫০ থানায় ৫৬২টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫৫টি রেস্তোরাঁ, ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার রাখার দোকান, ৩টি কেমিক্যাল গোডাউন। মামলা হয়েছে ৫টি। এসব অভিযান প্রসিকিউশন হয়েছে ২৯৯টি। সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছে ডিএমপির উত্তরা বিভাগ, যার সংখ্যা ১২২টি। এ বিভাগে প্রসিকিউশন করা হয়েছে ৪৮টি। অভিযানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রমনা বিভাগ। এ বিভাগে ১১০টি অভিযান চালিয়ে ২৭টি প্রসিকিউশন করে পুলিশ।
অন্যদিকে মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ওয়ারী বিভাগের গেণ্ডারিয়া থানা এলাকার জমজম ও জিম টোয়েন্টিটু রেস্তোরায় অভিযানে যায় পুলিশ। কিন্তু পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত সটকে পড়েন রেস্তোরাঁ দুটির কর্মচারীরা। অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস সিলিন্ডার রাখায় চারটি সিলিন্ডার ও দুটি চুলা জব্দ করা হয়েছে। ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এসএম শামীম যুগান্তরকে বলেন, অভিযানকালে নানা ধরনের ত্রুটি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্যাস সিলিন্ডারগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, গত দুইদিনের অভিযানে দেখা গেছে বেশির ভাগ রেস্তোরাঁর রান্নাঘর অপরিচ্ছন্ন ও ঘিঞ্জি। কোনো কোনো রান্নাঘর ছয় ফুট বাই আট ফুট। সেখানে ৫ থেকে ৬ জন বাবুর্চি কাজ করছেন। ওইসব রুমে আবার দুই-তিনটি বড় ইলেকট্রিক ওভেন, ৪ থেকে ৫টি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা। সব মিলে এক মৃত্যুকূপে চলছে রেস্তোরাঁর কার্যক্রম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
মিরপুরে অভিযানের বিষয়ে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. জসীম উদ্দিন মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ৪৩টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে ২৭টি প্রসিকিউশন দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্তোরাঁয় অনিরাপদ দাহ্য পদার্থ ব্যবহারের কারণে বিশেষ অভিযান চালিয়েছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। এ সময় রেস্তোরাঁর মালিক, ম্যানেজারসহ ৩৫ জনকে আটক করা হয়েছে। সোমবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, রিং রোড, তাজমহল রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় এ অভিযান চালানো হয়।
Leave a Reply