টানা পতনে ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক। ডিএসইর সূচকের এ অবস্থান ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত সপ্তাহে সূচক ১৪৪ পয়েন্ট কমেছে। এর ফলে ডিএসইর মূল্যসূচক কমেছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। পতনের এ ধারা কোথায় গিয়ে থামবে, তা পরিষ্কার নয়। কারণ, সূচক ৬ হাজার পয়েন্ট একটি মনস্তাত্ত্বিক সীমা ছিল। এটি ভেঙে যাওয়ায় বর্তমানে শেয়ারবাজারে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে এ মুহূর্তে ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক বিক্রয়) না করার অনুরোধ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে আস্থার সংকটে পুঁজিবাজার। এ সংকট কাটাতে কী উদ্যোগ নিতে হবে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমি দীর্ঘদিন বলে আসছি, এ বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট রয়েছে। এ সংকট কাটাতে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে করণীয় দুটি-সুশাসন এবং ভালো কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানো। তিনি বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কারসাজির শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা দিতে হবে, কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে বিচার হবে। না হলে ঝুঁকি নিয়ে কেউ বিনিয়োগে আসবে না। তবে বিএসইসি বলছে, শিগ্গিরই ঘুরে দাঁড়াবে বাজার।
ফ্লোর প্রাইস (নিম্নসীমা) উঠে যাওয়ার পর বাজারে টানা দরপতন চলছিল। এরপর রোববার বাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় আইটি বিপর্যয় হয়। এতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমেছে। এ অবস্থায় তারা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন। ফলে এক সপ্তাহে সূচক ১৪৪ পয়েন্ট কমেছে। এছাড়াও সূচকে একটি মনস্তাত্ত্বিক সীমা ছিল ৬ হাজার পয়েন্ট। অর্থাৎ সাম্প্রতিক সময়ে সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নামেনি। কিন্তু বুধবার তাতে ছন্দপতন হয়। ডিএসইর ব্রড সূচক এদিন আগের দিনের চেয়ে ৩২ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯৭৪ পয়েন্টে নেমে এসেছে। সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবার আরও ৬ পয়েন্ট কমেছে। ডিএসইর প্রধান সূচকের এ অবস্থা ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের ৫ মে সূচক ৫ হাজার ৮৮৪ পয়েন্টে নেমেছিল। তবে এর আগে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই সূচক ৫ হাজার ৯৮০ পয়েন্টে নামলেও অবস্থান বুধবারের চেয়ে ওপরে ছিল। অর্থাৎ ৩ বছরেও সূচক এত নিচে নামেনি। এ অবস্থায় বাজারে আতঙ্ক রয়েছে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যাচ্ছেন। এটি বাজারের জন্য শঙ্কার কারণ। তবে বিএসইসি থেকে বাজার ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে মার্জিন ঋণের বিপরীতে ফোর্সড সেল বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কোনো কোনো হাউজকে শেয়ার কেনার অনুরোধ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ৬ হাজার পয়েন্ট বাজারের জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক সীমা ছিল। আমরা আশা করেছিলাম সূচক এর নিচে নামবে না। কিন্তু বুধবার সেই সীমার নিচে নেমেছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক রয়েছে। এছাড়া বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ফোসর্ড সেল করেছে। তবে আমরা আশাবাদী দ্রুতই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। শেয়ারবাজার স্ট্যাবিলাইজেশন তহবিলের অর্থ ছাড় হলে বাজারে তারল্য বাড়বে। এছাড়াও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো পেশাদার আচরণ করলে বাজার ঘুরতে সময় লাগবে না। তবে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে পতন ঘটানোর চেষ্টা করলে কোনো ধরনের ছাড় নয়। এ ব্যাপারে বিএসইসির সার্ভিল্যান্স সক্রিয় রয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে কেউ বাজারে কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করলে বাজারের স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত সপ্তাহে পাঁচদিনে ডিএসইতে ২ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৫৫৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে পাঁচদিনে ৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। প্রতিদিন গড়ে ৮১০ কোটি টাকা হয়েছিল। এ হিসাবে গত সপ্তাহে লেনদেন কমেছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন কমেছে ২৫২ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ডিএসই ব্রড সূচক ১৪৪ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯৬৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। গত সপ্তাহে ৪১১টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৬৯টি কোম্পানির শেয়ারের, কমেছে ৩১১টি এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩১টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। তবে ১০টি কোম্পানির কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি। গত সপ্তাহের শুরুতে ডিএসইর বাজারমূলধন ছিল ৭ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। সপ্তাহ শেষে তা কমে ৬ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ হিসাবে বাজারমূলধন ৪৯ হাজার কোটি টাকা কমেছে। একক কোম্পানি হিসাবে গত সপ্তাহে কর্ণফুলি ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম ২৩ শতাংশ কমেছে। ফুয়াং সিরামিক ১৬, আমরা নেটওয়ার্ক ১৩ এবং তৌফিকা ফুডের দাম ১১ শতাংশ কমেছে। তবে দুর্বল কোম্পানি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরির শেয়ারের দাম ৬০ এবং এসএস স্টিলের শেয়ারের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। গত সপ্তাহে ডিএসইতে শীর্ষ দশের তালিকায় থাকা কোম্পানিগুলোয় ৮৯২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, যা বাজারের মোট লেনদেনের ৩১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম অবস্থানে থাকা ফুয়াং সিরামিকের লেনদেন ১৫৯ কোটি, দ্বিতীয় অবস্থানে গোল্ডেন সনের লেনদেন ১২৫, তৌফিকা ফুডের ১১২ কোটি এবং ওরিয়ন ইনফিউশনের ১১০ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
একক দিন হিসবে ডিএসইতে বৃহস্পতিবার ৩৯৪টি কোম্পানির ১৬ কোটি ৯৪ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যার মোট মূল্য ৫১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১৬৫টি কোম্পানির শেয়ারের, কমেছে ১৭১টি এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৫৮টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। ডিএসইর ব্রড সূচক আগের দিনের চেয়ে ৬ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯৬৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসই-৩০ মূল্যসূচক ৪ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৫১ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২৯৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে।