সত্য জবাবদিহিতা কমিশনের সার্বিক কার্যক্রম সর্ব্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হওয়ার পর অন্যান্য দপ্তরের আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তাদের মতোই সওজ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের কার্যক্রম শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সদ্য সড়ক উপ-বিভাগ-২, নারায়ণগঞ্জে বদলীকৃত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এমদাদুল হক (পরিচিনি নং ১০০০২৮) এর বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালা ১৯৮৫ এর ২(এফ) এর সজ্ঞা ও ৩(বি) এবং ৩(ডি) বিধি মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, সড়ক ভবন, তেজগাঁও, ঢাকার স্মারক নং ১সিই-৩/২০১২(ঢাকা)/৬৬/তদন্ত, তারিখ: ০১/০২/২০১২ মূলে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়।
গত ১৫/০১/২০১৭ খ্রিঃ তারিখ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ১সিই-৩/২০১২(ঢাকা)/১৪/তদন্ত মূলে এক দপ্তরাদেশের মাধ্যমে তৎকালীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান (পরিচিতি নং ০০১০৩৩) জয়দেবপুর সড়ক উপ-বিভাগ, গাজীপুরের উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল), (তৎকালীন প্রাক্তন কর্মস্থল সড়ক উপ-বিভাগ, নরসিংদী) বর্তমানে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) সওজ, সড়ক উপ-বিভাগ-২, বনানী ঢাকা হতে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পদে সড়ক উপ-বিভাগ-২, নারায়ণগঞ্জে বদলীকৃত এমদাদুল হক (পরিচিনি নং ১০০০২৮)কে দুর্নীতি এবং অসদাচরণের অভিযোগ প্রমানীত হয়নি মর্মে অভিযোগের দায় হতে অব্যহতি প্রদান করেন।
দুর্নীতি এবং অসদাচরণের অভিযোগের দায় থেকে অব্যহতি পাওয়ার পর পদোন্নতি হাসিল করতে শুরু হয় অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের দৌড়ঝাঁপ। সওজ’র দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তারাও এমদাদুল হকের অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের ভাগিদার হয়ে যান। শুরু হয় দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য।
কর্তাদের অর্থ দিয়ে বাগিয়ে নেন কয়েক দফা পদোন্নতি। মোটা অংকের ইনকামের জায়গা হিসেবে এমদাদুল হক বেছে নেন সওজ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়কে। তাই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বরাবরই চলে আসেন সড়ক উপ-বিভাগ-২, নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে। ইতিমধ্যে এমদাদুল হক ব্যাপক সম্পত্তি, টাকা পয়সা, গাড়ি বাড়ির মালিক বনে গেছেন। ঢাকা মেট্রো-চ ২০-৪৫৪২ নং মাইক্রোবাসটি তার নিজের। মাইক্রোবাসটির মূল্য আনুমানিক ৮০ লক্ষ টাকা। রাজধানীর ধানমন্ডির গ্রীন রোডস্থ উদয় গ্রীন, ১৪ গ্রীন স্কয়ারের ভবনটিতে তার নিজের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ৩ কোটি টাকা হবে। এছাড়াও রয়েছে নামে বেনামে অঢেল টাকার সম্পদ। অবৈধ উপায়ে অর্জিত বেশীরভাগ টাকা পয়সা তার আত্মীয়-স্বজন এবং কাছের মানুষদের নামে রেখেছেন। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ তিনি বিদেশে স্থানাত্তর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
আইনগত নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সকল মামলা স্থগিত ছিল। দুদকের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে শিথিলতা বা ছাড় দেবার কোনো সুযোগ নেই মর্মে দুদক সূত্রে জানা যায়।
একারনে বিলুপ্ত সত্য ও জবাবদিহীতা কমিশনে (ট্রুথ কমিশন) আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে মামলার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের ইতিমধ্যে পৃথক মামলা দায়ের ও চার্জশিট দিয়েছে কমিশন।
অপরদিককে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ হওয়া সত্ত্বেও উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, সড়ক উপ-বিভাগ-২, নারায়ণগঞ্জে বদলীকৃত এমদাদুল হক (পরিচিনি নং ১০০০২৮)কে তৎকালিন কিভাবে দুর্নীতি এবং অসদাচরণের অভিযোগ প্রমানীত হয়নি মর্মে অভিযোগের দায় হতে অব্যহতি প্রদান করলেন সেটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে। কেননা একই অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা রুজু হয়। আদালতে বিচারের জন্য অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে এবং অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলায় গুরুদণ্ড আরোপ করারও নজির রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ভলান্টারি ডিসক্লোজার অব ইনফরমেশন অর্ডিন্যান্স জারি করে মাত্র ৫ মাসের জন্য `সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশন (ট্রুথ কমিশন) গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। একই বছর ৩ আগস্ট ট্রুথ কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। অধ্যাদেশ অনুযায়ী ২০০৯ এর ২ জানুয়ারি এটি বিলুপ্ত হয়। এ পাঁচ মাসে ৪শ’ ৯১ জন দুর্নীতিবাজ অনুকম্পার জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে ৪শ’ ৫২ জনকে আর্থিক জরিমানার মাধ্যমে মার্জনা করে ট্রুথ কমিশন। একই সময় ওই অধ্যাদেশ ও কমিশনের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বর্তমান সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমানসহ পাঁচজন আবেদনকারী হাইকোর্টে রিট করেন।
হাইকোর্ট ওই বছর ১৩ নভেম্বর এক রায়ে ট্রুথ কমিশনের কার্যক্রম ও সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে আপিল বিভাগও ওই আদেশ বহাল রাখেন। এর ফলে ওই অনুকম্পা বেআইনি বলে গণ্য হয়। এখন ধরে নিতে হবে কেউ অনুকম্পা পায়নি। এর ফলে অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ দুদক যেভাবে পরিচালনা করে তাদের ক্ষেত্রেও সেই একইভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালিত হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে দুদক ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, আদালত এক রায়ে বিলুপ্ত সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনকে অবৈধ ঘোষণা করে। এরপর আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম সচল করার সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। মোট ৪শ’ ৫২ আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজের মধ্যে দুদকের তালিকাভুক্ত ২শ’ ৯৭ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাকিরা ২০০৮ সালের গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির (এনসিসি) হওয়া ট্রুথ কমিশনে যাওয়ায় তাদের ব্যাপারেও সার্বিক তথ্য চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল দুদক। দুদকের তালিকাভুক্ত আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান করার জন্য দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মোনায়েম হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি ইতিপূর্বে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবু সালেহ মো. নুরুজ্জামান ও বিআরটিএ টাঙ্গাইল অঞ্চলের সহকারী পরিচালক কাজী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।
আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধানের সত্যতা নিশ্চিত করতে দুদক হতে বলা হয়েছিল, ট্রুথ কমিশন থেকে যারা অনুকম্পা পেয়েছেন তাদের প্রত্যেকের ফাইল খুঁটিয়ে দেখা হবে। তারা কী পরিমাণ সম্পদের বিপরীতে অনুকম্পা পেয়েছিলেন- সে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা হবে। এ ছাড়া ট্রুথ কমিশন বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে তারা কী পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং সেসব সম্পদের উৎসও খতিয়ে দেখা হবে। সার্বিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। অনুকম্পা নিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। দুর্নীতিবাজদের কাউকে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না।
এ বিষয়ে দুদক প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বৈঠকে ট্রুথ কমিশন থেকে অনুকম্পা পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধানের বিষয়ে এ নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এতে বলা হয়, ‘সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনের বিলুপ্তির পরদিন থেকে অদ্যাবধি অর্জিত সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য অপরাধ স্বীকারকারী ব্যক্তিদের প্রতি দুদকের নিয়ম-পদ্ধতি অনুসর করে সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করতে হবে।
সত্য ও জবাবদিহি কমিশন (ট্রুথ কমিশন) থেকে মার্জনা পাওয়া আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ফের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজনের সম্পদের তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে। শিগগিরই মার্জনা পাওয়া ৪৪৮ জনের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করা হবে। ইতিপূর্বে কমিশন বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত রাগ-অনুরাগের ভিত্তিতে নয় বরং দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ করে দেশে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের অনিয়মের বিষয়ে তৎকালীন সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে (ট্রুথ কমিশন) অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের দায় লিখিতিভাবে শপথপূর্বক স্বীকার করে গত ২২/১২/২০০৮ তারিখে ট্রেজারি চালান নং ০৮/৮ এর মাধ্যমে ২ লক্ষ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা প্রদান করার পর দুর্নীতি এবং অসদাচরণের অভিযোগ প্রমানীত হয়নি মর্মে অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে তাকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যহতির বিষয়ে জানতে চাইলে এমদাদুল হক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পদোন্নতির বিষয়ে বলেন, নিয়ম মেনেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে। ঘুরেফিরে সওজ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়েই বারবার বদলী এবং গাড়ি বাড়ির মালিক হওয়ার স্বপক্ষে জানতে চাইলে সড়ক উপ-বিভাগ-২, নারায়ণগঞ্জে সদ্য বদলীকৃত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এমদাদুল হক জানান, এসব বিষয়ে জানতে আপনাকে অফিসে এসে কথা বলতে হবে।
অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের দায় লিখিতিভাবে শপথপূর্বক স্বীকার করে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ২ লক্ষ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা প্রদান করার পর দুর্নীতি এবং অসদাচরণের অভিযোগ প্রমানীত হয়নি মর্মে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অভিযোগের দায় থেকে সওজ’র কোনো কর্মচারীকে অব্যহতি দেওয়া আইনসংগত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, এটি আইনী প্রক্রিয়ার বিষয়। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এরকম করা হয়ে থাকলে ঠিক আছে কিন্তু ব্যাতিক্রম কিছু হয়ে থাকলে প্রমান পেলে কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধা নেই।
Leave a Reply